যুগ যুগ ধরেই আমাদের সমাজ শ্রেণিবিভক্ত। শাসক ও শোষিত ছাড়াও বিত্তের দিক থেকে বিভক্তি লক্ষণীয়। এই শ্রেণিবৈষম্য যেকোন সংকটে প্রকট হয়ে ওঠে। সংকট ছাড়াও শ্রেণিশত্রুর অভাব নেই। কারণ সমাজে নানাভাবে শ্রেণিকরণ করা হয়। এর সর্বজনগ্রাহ্য কোনো পরিমাপক নেই। অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে যে শ্রেণিকরণ করা হয়। তবে যে শ্রেণি একই সাথে দরিদ্র আবার ধনী শ্রেণির মধ্যে দোল খেতে থাকে, সেই দোদুল্যমান শ্রেণিটিই মধ্যবিত্ত।
বিত্ত-বৈভবের দিক থেকে আমাদের সমাজ তিন শ্রেণিতে বিভক্ত। যেমন-
১. উচ্চবিত্ত
২. মধ্যবিত্ত
৩. নিম্নবিত্ত
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক হিসাবমতে, বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষের চার কোটি পরিবার রয়েছে। এরমধ্যে নিম্নবিত্ত ২০ ভাগ আর উচ্চবিত্ত ২০ ভাগ। মাঝের যে ৬০ ভাগ- এরা নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ মধ্যবিত্ত। এরা সংখ্যায় আড়াই কোটি পরিবার হবে।
কথায় বলে, মধ্যম পন্থা না-কি উত্তম। তবে দেখা যায়, যেকোন সংকটে এই মধ্যবিত্তরাই বেশি নাজেহাল হন। উচ্চবিত্তরা প্রায়ই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকেন। অভাব তাদের স্পর্শ করে না। মধ্যবিত্তরা সারাটা জীবন টানাপড়েনের মধ্যদিয়ে জীবন অতিবাহিত করেন। তাদের আত্মসম্মান টিকিয়ে রাখতে অনেক কিছুই সহ্য করতে হয়। কিন্তু নিম্নবিত্তরা এ ক্ষেত্রে অনেক স্বাধীন। তাদের অভাব থাকলেও টানাপড়েনের বালাই নেই। আত্মসম্মানও তত প্রখর হতে হয় না। জীবনকে একভাবে টেনেটুনে নিয়ে চলেন তারা।
বাস্তবতা হচ্ছে, সাম্প্রতিক করোনা দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি সংকটে আছেন মধ্যবিত্তরা। কারণ তাদের তেমন সঞ্চয় থাকে না। বিত্তশালীরা জমানো টাকায় অবরুদ্ধ জীবন আরামেই কাটাতে পারেন। কিন্তু মধ্যবিত্তের সে উপায় থাকে না। অন্যদিকে নিম্নবিত্তরা চেয়েচিন্তে দিন কাটাতে পারে। কিন্তু মধ্যবিত্তরা তা-ও পারেন না। ওই যে, আত্মমর্যাদার কথা বললাম।
মধ্যবিত্তের সংকট এবার ঘরে এবং বাইরেও। ঘরে নিত্যদিনের চাহিদার জোগান। বাইরে করোনার ভয়। পাশাপাশি কর্মস্থলের অতি নাটকীয় পরিবর্তন তো রয়েছেই। কর্মহীন নিম্নবিত্তের চেয়ে চাকরিহীন মধ্যবিত্ত অনেক বেশি অসহায়। একজন মধ্যবিত্ত একসময় না পারে কায়িক শ্রম দিতে, না পারে সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে। করোনার কারণে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাদের। যেমন-
১. চাকরিচ্যুত হওয়া
২. বেতন কেটে নেওয়া
৩. বেতন বন্ধ হওয়া
৪. বাধ্য হয়ে চাকরি ছেড়ে দেওয়া।
এসব কারণে বাসা ভাড়া দিতে না পেরে শহর ছেড়েছেন অনেকেই। গ্রামে গিয়েও বেকার বসে থাকা। যাদের দু’একটু সঞ্চয় ছিল, তা-ও গত চার মাসে শূন্যের ঘরে। কিন্তু তারা কারো কাছে হাত পাতেন না। ত্রাণের লাইনে দাঁড়াতে পারেন না। কোনো ধরনের প্রণোদনাও পান না।
নিম্নবিত্তরা তা-ও কাজ হারিয়ে ত্রাণের জন্য ছুটেছেন। একটি কাজ বন্ধ হলে বিকল্প কাজটি খুঁজে নিয়েছেন। মধ্যবিত্তরা কিন্তু হুট করেই বিকল্প কাজটি পেয়ে যান না। ফলে রাতের অন্ধকারে গুমড়ে কাঁদা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। এমনকি দীর্ঘদিনের তিলে তিলে গড়ে তোলা সংসার মধ্যরাতে, সকালে অথবা দুপুরে তারা তুলে দিচ্ছেন পিকআপের ওপর। ফিরে যাচ্ছেন গ্রামে। অনেকদিন আগে যে গ্রাম ছেড়ে এসেছিলেন। কথা হচ্ছে, সেখানেও তাদের সামনে অপেক্ষা করছে অনিশ্চয়তা। একদল ফিরে গেছেন বাড়ি। বাকিরা লড়ছেন এখনো এ শহরে। স্রেফ টিকে থাকার সংগ্রাম। জিডিপি, ঊর্ধ্বমুখী ভবন, বড় বড় ফ্লাইওভার, স্বপ্নের মেট্রোরেলও যে জীবনমানের প্রকৃত নির্দেশক নয়, তা এখন আরও পরিষ্কার হয়ে গেছে। ভোগবাদী এ সমাজে মধ্যবিত্ত প্রায় সবসময়ই বিপদে ছিল। এখনো আছে। ভবিষ্যতেও হয়তো থাকবে।
আমাদের দেশে বেসরকারি চাকরিতে সবচেয়ে বেশি মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। এ মধ্যবিত্তের ঘাম ঝরানো বিত্তেই যিনি উচ্চবিত্ত হন, তিনিই আবার সুযোগ বা উপলক্ষ পেলে ঘাড় ধরে বের করে দেন। মধ্যবিত্ত তখন নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির ৪৮ দশমিক ৪ শতাংশ বা প্রায় অর্ধেকই বেসরকারি চাকরি করে। আর ২০ শতাংশের বেশি সরকারি চাকরি করে। মধ্যবিত্তের প্রায় ২২ শতাংশ ব্যবসা করে। নিম্নমধ্যবিত্তের মধ্যে ৫১ দশমিক ৬ শতাংশ বেসরকারি চাকরি করে। আর ব্যবসায় সম্পৃক্ত মাত্র ১৭ শতাংশ। এ তথ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, বর্তমানে সরকারি চাকরির বেতন–ভাতা বাড়লেও বেসরকারি খাতের বেতন আনুপাতিক হারে বাড়েনি। ভবিষ্যতে বাড়বে কি-না এখনো অজানা।
আমাদের দেশের মধ্যবিত্তরা সব সময় অমানবিক জীবন যাপন করেন। তারা নিজের সর্বস্ব দিয়ে অন্যের সফলতা এনে দেন। এমন মানবিকতার সংকট শুধু করোনাকালেই নয়। যেকোনো যুদ্ধ-বিগ্রহ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মন্দা বা দুর্ভিক্ষেও তারা মানবিকতার সংকটে পতিত হন। এ ছাড়াও গত চার দশকে বিশ্বে মধ্যবিত্তের অবস্থা খারাপ হয়েছে বলেও অর্থনীতিবিদরা বলছেন।
তাই এ সংকট থেকে বের হয়ে আসতে চাইলে প্রথমত নিজেকেই উদ্যোগী হতে হবে। পাশাপাশি সরকারও উদ্যোগ নিতে পারে। তবে ব্যক্তি উদ্যোগের মধ্যে-
১. নিজের জমিদারি ভাব দূর করতে হবে।
২. সামাজিক স্ট্যাটাস বজায় রাখার যুদ্ধে কৌশলী হতে হবে।
৩. সব ধরনের বিলাসিতা পরিহার করতে হবে।
৪. উচ্চবিত্তের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা যাবে না।
৫. নিজেকে নিম্নবিত্ত ভেবে খরচ করতে হবে।
৬. যতটা সম্ভব হিসেবি হয়ে চলতে হবে।
অর্থাৎ প্রতিমাসেই সঞ্চয় করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। কোনো মাসে অতিরিক্ত আয় বা উপার্জন হলে তা জমিয়ে রাখতে হবে। তবেই না যেকোনো সংকটে নিজেকে শক্তিশালী ভাবে তৈরি করে তা মোকাবেলা করা সম্ভব হবে।
তবে সারা বিশ্বেই মধ্যবিত্ত শ্রেণি সংকুচিত হচ্ছে। সম্প্রতি বিবিসির এক জরিপে বলা হয়েছে, ‘মধ্যবিত্ত শ্রেণি সমাজের ভারসাম্য বজায় রাখে। সে জন্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংকুচিত হওয়া বা তাদের হতোদ্যম হয়ে যাওয়া সমাজের জন্য ভালো নয়। ঐতিহাসিকভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণি উদার গণতন্ত্রের সমর্থক। ফলে এ শ্রেণি মার খেলে উদার গণতন্ত্রও মার খাবে। সমাজে চরমপন্থার বিস্তার ঘটবে।’ এখন কথা হচ্ছে- মধ্যবিত্ত যদি সমাজের ভারসাম্য বজায় রাখে, তাহলে মধ্যবিত্তের ভারসাম্য বজায় রাখার দায়িত্ব কে নেবে? এমন প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়।
সুতরাং পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি ভেবেই মধ্যবিত্তকে সংগ্রাম করতে হবে। নিজের সংকট নিজেকেই মোকাবেলা করতে হবে। আর সে জন্য পূর্ব থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। পৃথিবী যতদিন থাকবে, দুর্যোগ ততদিন থাকবে। আর তার পাশাপাশি মধ্যবিত্তরাও থাকবে। ফলে মধ্যবিত্তকেই বেছে নিতে হবে মানবিক সংকট কাটিয়ে ওঠার মূলমন্ত্র।
লেখক: কবি, কথাশিল্পী ও সাংবাদিক।