1. admin@sahittyadiganta.com : সাহিত্য দিগন্ত ডেস্ক : সাহিত্য দিগন্ত ডেস্ক
  2. editor.sahittodigonto@gmail.com : সম্পাদক : জায়েদ হোসাইন লাকী : সম্পাদক : জায়েদ হোসাইন লাকী
একটি অসমাপ্ত গল্প, জায়েদ হোসাইন লাকী | সাহিত্য দিগন্ত পত্রিকা
বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৫১ অপরাহ্ন

একটি অসমাপ্ত গল্প, জায়েদ হোসাইন লাকী

মেহবুবা হক রুমা I সাহিত্য ডেস্ক
  • প্রকাশের সময় : রবিবার, ১৬ জুলাই, ২০২৩
  • ৪০১ বার এই সংবাদটি পড়া হয়েছে
একটি অসমাপ্ত গল্প : জায়েদ হোসাইন লাকী
-আজ তোমাকে শাস্তি পেতে হবে !
সিমী আমার দিকে ভয়ংকর মূর্তিতে আগাতে আগাতে বলতে থাকে। আমি এ মুহূর্তে কি করব তা বুঝি না। আজ সিমীকে কেমন বেসামাল আর অদ্ভুত লাগছে।
-কি রকম শাস্তি? আমি বলি।
সিমী চিলের মতো করে ছোঁ মেরে আমাকে ওর বুকের ভিতরে জাপটে ধরে। বাম হাত দিয়ে আমার মাথার চুলে আঙ্গুল প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে পাগলের মত করে আমার মুখে, কপালে চুমো খায়। আমার ঠোঁটে ওর ইঁদুরের মতো ধারালো দাঁত দিয়ে কামড়ে দিয়ে বলে।
-এবার বুঝলে কি রকম শাস্তি?
সিমীর এই আকম্মিক আচরণে আমি কি হাসবো কি কাঁদব বুঝি না। আমি সিমির কথার কোনো উত্তর খুঁজে পাই না। কোনো নারী এভাবে কাউকে পাগল করে দিতে পারে আগে আমি তা কখনো টের পাইনি। আমি পুড়তে থাকি সিমীর ভালবাসার জোস্নার আলোয়। সিমী তার ভালো লাগার সমস্ত আবেগগুলোকে আমার বুকে প্রজাপতির মত করে নিঃশংকোচে বিলাতে থাকে। জীবনানন্দের সুরঞ্জনার মতো ওর রংমাখা ঠোঁটের বিষাক্ত বিষনীল স্পর্শে আমার সমস্ত মুখটা ভোরের আকাশের প্রথম সূর্যের মতো লাল হয়ে ওঠে। আমি সিমীকে দুহাতে আঁকড়ে ধরি আঙ্গুরলতার মতো। আমাদের নিঃশংকোচ পৃথিবীতে আমরা দু’জন সন্ধ্যাকাশের তারার মত করে জ্বলতে থাকি। সিমী আমার বুকে মুখ লুকিয়ে ভালবাসার স্পর্শ গুলোকে তির্যক সমীকরণে যোগ করে, ভাগ করে, আবার কষ্টগুলোকে বিয়োগ করে, ঘর বাঁধার স্বপ্ন বুনে। সিমী তার লাল-নীল স্বপ্ন গুলোকে আমার বুকের জমিনে আবাদ করে করে কৃষক হয়। আর আমি নন্দগোপালের মত সিমীর বুকে মুখ ঘষে ঘষে প্রেমের নৌকা ভাসাই। সিমী তখন স্বপ্ন বুনা কৃষক। আমি  নন্দগোপাল হয়ে সুখের সাগরে ভাসতে থাকি দীর্ঘক্ষণ। আমরা দু’জন স্বপ্নের সীমানায় পা রাখি আর আগামী দিনের সুখস্বপ্নের স্কেচ করি। সিমী আমাকে দু’হাতে জাপটে ধরে আদর করতে থাকে। সময়গুলোকে হিসেব কষে পার হতে হতে নিখুঁত অন্ধকারেও আমাদের ঠিক পাশে কোথায় যেন ছন্দ পতনের শব্দ হয়। আমরা দুজন বিচ্ছিন্ন হই অযাচিতভাবে দুজনের বাহুবন্ধন থেকে। সিমির ভাবী আমাদের দু’জনকে এমন বেহাল অবস্থায় দেখে লজ্জায় দুহাতে মুখ ঢাকে আর পিট পিটিয়ে হাসতে হাসতে পাস কাটিয়ে চলে যায়। সিমী আমাকে পুনরায় জাপটে ধরে। সিমীর বাহু বন্ধন হতে আমি নিজেকে মুক্ত করতে চেষ্টা করি। সিমী দ্বিগুণ শক্তি দিয়ে আমাকে লাউপাতার মতো আঁকড়ে ধরে। আমার মুখে আলতো করে চিমটি কেটে সিমী ফিস ফিসিয়ে বলেঃ
-অ্যাই, তুমি আমাকে কবে ঘরে তুলবে বল তো?
-ব্যস্ত হচ্ছো কেন জান, সবেতো প্রেম শুরু হলো। আমি বলি
-তাহলে, তুমি কি আমার হবে না?
-আমি তো তা বলিনি সিমী।
-তবে কেন ঘরে তুলে নিচ্ছ না।
-যদি না নিই! আমি দুষ্টুমি করে বলি।
সিমীর চোখ দুটো আপনা থেকেই টলটল করে ওঠে আর ছল ছল করে ক’ফোঁটা ‘সুখ’ আমার বুকের উপরে চুইয়ে পড়ে।ওর কান্না দেখে আমি ভড়কে যাই। নিজেকে সামলে মিয়ে বলিঃ
-আমি তো ফান করে বলেছি।তুমি কাঁদছ ক্যানো ডারলিং?
-আমার ভালবাসা নিয়ে তুমি ফান করো?!
-আমি তো এমনিতেই বলেছি। বোকা মেয়ে।
-আমি কি তোমাকে আপন করে কখনই পাবো না?
 সিমী বলতে বলতে আবার কেঁদে ওঠে।
মাঝে মাঝেই সিমী আমার বুকে মাথা রেখে কাঁদে। কি সুখে ও এভাবে কাঁদে আমি তা বুঝতে পারি না। ওর কান্নার ঢেউগুলো যখন চুইয়ে চুইয়ে আমার বুকে এসে পড়ে, আমার বুকের স্বপ্নগুলো তখন এলোমেলো হয়। পৃথিবীটাকে তখন আমার কাছে বড় তুচ্ছ বলে মনে হয়, সুতো কাটা ঘুড়ি বলে মনে হয়। সিমীর কান্নার ঢেউগুলো আমার বুকে এসে দাপটে ঘর বাঁধে। আমি সিমীকে কান্না থামাতে বলি না। ইচ্ছে করেই বলি না। দু’হাতে অঞ্জলি করে আমি ওর মুখটিকে আলতো করে উপরে তুলি। এখনও সিমীর চোখ দুটো মুক্তোর মত অশ্রতে কেয়ারি করে সাজানো। সিমীর অশ্র গুলোকে আমার কাছে ভেনাসের অশ্র বলে মনে হয়। যিশুখ্রিস্টের কুমারী মাতা মেরি চোখের অশ্রর মতো পুণ্য পবিত্র বলে মনে হয়। নিজেকে আমার কেমন সৌরকেন্দ্র বলে মনে হতে থাকে। সৌরজগৎকে ঘিরে গ্রহ-নক্ষত্রগুলো যেমন ঘুরতে থাকে। সিমীও ঠিক তেমনি আমাকে কেন্দ্র করে অনবরত ঘোরে, ঘুরতে থাকে। আমি সিমীকে হাসাতে পারি। আমি চাইলেই সে বালিহাঁসের মতো করে ঝিলিক দিয়ে হেসে উঠবে। আমি সিমীকে কাঁদাতে পারি। আমি চাইলেই সে আসমানের মত করে কাঁদবে। নিজেকে বাজিকর পুরুষ ভেবে আমি এক বিস্ময়কর সুখ অনুভব করতে থাকি। আমি বাড়ির দিকে পা বাড়াতে যাই। সিমী আমার সার্টের কলার চেপে ধরে। ওর চোখে কান্নার দাগগুলো মুছতে না মুছতেই পুনর্বার চোখ দুটো অশ্রতে চিকচিক করে ওঠে। সিমী বাম হাতে চোখ কচলাতে কচলাতে বলেঃ
-তোমাকে ছুঁতে না পারলে আমার কষ্ট হয়।
-ছুঁয়ো না।
-তবে তো আমি মরে যাব।
-মৃত্যু কি এতই সহজ।
-একবার ছুঁতে না দিয়েই দ্যাখো না!
-যদি সত্যিই তাই হয়!
-বললাম তো, আমি মরে যাব।
সিমীর কথায় আমার বড্ড হাসি পায়। আমি ওর বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে বাড়ির দিকে পা রাখি। একবার পেছন ফিরে তাকাতে ইচ্ছা হয়। তাকাই না অথবা তাকাতে পারি না। সিমীকে একদিন না ছুঁলে আমারও যে কষ্ট হয়। এ কথা আমি ওকে বুঝতে দিই না। শুধু ওর কান্নাগুলোকে আমি বুকে বেঁধে কান্নার পিরামিড গড়ি। সেই পিরামিডের ভেতরে আমি সিমীর ভালবাসাকে মমি করে সাজিয়ে রাখি।
দিন গুনে দিন চলে যায়। এভাবে অনুক্ষণ সিমী আমাকে সৃজন করে চলে প্রতিনিয়ত। প্রত্যক বিকেলে, অথবা সন্ধ্যায়, সিমীর সাথে দেখা হওয়ার পরই আমি বদলে যাই একটু একটু করে। সিমী আমাকে যেমনটি দেখতে চায়, আমি ঠিক তেমন হয়ে উঠি। আমি মহাপুরুষ হয়ে উঠি। সিমী আমার ভেতরের পুরুষটাকে জাগিয়ে তোলে। তাকে আমি প্রতিদিনই দেখি আর নতুন করে আবিষ্কার করি। সিমী আর আমি ভালবাসার খেয়া বেয়ে বেয়ে অপলক সময়গুলোকে চোখের পলকে পার করে দিই। এভাবে পার হয় কতটা দিন অথবা কত লক্ষ সেকেন্ড আমরা তার হিসাব কষি না। একদিন সিমির ভাবী আমাকে হাত ধরে টানতে টানতে তার ঘরে নিয়ে যান। আমার হাতের আঙ্গুলগুলো নিয়ে খেলা করতে করতে বলেনঃ
-এভাবে আর কতদিন চালাবে সুমন? এবার আমার আদরের ননদিনীকে ঘরে তুলে নাও না ভাই।     নিজের ঘরে নিয়ে যত খুশি পারো আদর করো। কেউ বাধা দিবে না।
-কেন? আপনার ননদিনীকে বিয়ে না করে আদর করা যাবে না?
-উ-হু, সেটি হবে না। বিয়ে করবে না অথচ আদর করবে, এটা কেমন করে হয়।
-হয়। বিয়ে না করেও আদর করা যায়।
-দেখ সুমন, আমি তোমার এসব কথা শুনতে চাই না।
 তুমি তাকে ঘরে নিবে কি না এটাই বড় কথা।
-ভাবী প্রেম করলেই যে তাকে বিয়ে করতে হবে এটা কিন্তু এ যুগে ঠিক না।
ভাবী আমার কথায় প্রতিবাদ করতে চায়। আমি ভাবীকে ইশারায় চুপ থাকতে বলি। সিমীকে রাগাচ্ছি এটা বুঝতে পেরে ভাবী চুপ হয়ে যায়। হঠাৎ সিমী আমার বাম হাত টেনে নিয়ে হাতের কব্জিতে প্রচণ্ড এক কামড় দিয়ে বলে ওঠেঃ
-যার সাথে প্রেম করবে তাকে বিয়ে করবে না তাই না?
 এই নাও তোমার হাতে কলঙ্কের দাগ দিয়ে দিলাম।
ভাবী সিমীর এই ছেলেমানুষি দেখে অবাক হয়ে যায়। ভাবী সিমির এই ভৌতিক আচরণে কিছুটা লজ্জাও পায়। এদিকে সিমী এভাবে কিছু করে বসবে, আমিও তা কল্পনাও করিনি। ভাবী আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। আমার হাতের কব্জিতে লাল লাল রক্তের ফোঁটাগুলো চুইয়ে চুইয়ে পড়তে থাকে। কেউ বিশ্বাস করবে কি না আমি জানি না, সিমীর কামড়ে আমার হাতে মোটেও ব্যথা লাগেনি। এতটুকু ব্যথা আমি অনুভব করিনি। আমি এক আশ্চর্য রকমের কোমলতা অনুভব করতে থাকি। আমি কোমলতার মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে থাকি। ভাবী তার আঁচল দিয়ে আমার হাতে রক্তের দাগগুলো মুছতে থাকে। আলতো করে তুলো দিয়ে স্যাভলন লাগিয়ে দেয় হাতে। স্যাভলন আমাকে তীব্র দহন করে। যেটা আমি সিমীর কামড়ে অনুভব করিনি। আমার আশ্চর্য সুন্দর কোমলতার সাথে পাল্লা দিয়ে জানালার পর্দাগুলোও কোমল হয়ে ওঠে। মৃদু দোলায় জানালার পর্দাটা কিঞ্চিত সরে যায়। পর্দার ফাঁক দিয়ে দুটি অশ্র ঝরা চোখ আমি দেখতে থাকি। সিমী চোখ দুটি দু’হাতে আড়াল করে দূরে সরে যায়। ভাবী আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলেনঃ
-কি শাস্তিটাই হয়ে গেল তাই না সুমন?
-শাস্তি শুধু আমারই না ভাবী, শাস্তি ওকেও পেতে হবে।
-তা কেমন শাস্তি দিবে শুনি? ভাবী বলেন
-তোমার মানুষ খেকো ননদিনী আমার হাত কামড়ে দিয়েছে, আমিও তার ঠোঁট কামড়ে দেবো দেখে নিও।
রানু ভাবী চোখ দুটি কপালে তুলে ফিসফিসিয়ে বলেনঃ
-ওমা কি মানুষ খেকো রে বাবা শুধু কামড়ানো কেন?
-ঠিক আছে কামড়ে দেব না তবে আমি তোমার ননদিনীকে একদিন কলঙ্কিত করে দেবো দেখো! বুঝলে ভাবী।
ভাবী আমার দিকে তাকিয়ে ধ্রবতারার মত হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে গড়াগড়ি যায়। তার হাসি থেকে আলো না শিশির না কি যে ঝরতে থাকে আমি তা বুঝতে পারি না। জানালার পর্দাটা আবারো মৃদু কেঁপে ওঠে। আমি সিমীর একজোড়া চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার রক্ত মাংস সবুজ ঘাস হয়ে মাঠের উপর ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আমার ইচ্ছে করে ওই চোখ থেকে ঝরেপড়া বৃষ্টিগুলো, অমৃতগুলো, কান্নাগুলো কৌটায় করে ভরে বুক পকেটে রেখে দিই। ভাবী কখন নিঃশব্দে আমার সামনে থেকে উঠে যায় আমি তা টের পাই না। সিমী আমার ব্যান্ডেজ বাঁধা হাতটিকে দু’হাতে জাপটে ধরে কাঁদতে থাকে। কোমল পেলব পরশে আমার হাতে হাত বুলাতে থাকে। ফ্যানের বাতাসে সিমীর চুলগুলো উড়ে এসে আমার বুকে মুখে লাগতে থাকে।
-তোমার চুলের গন্ধে আমার পেট ভরে যায়, আমি বলি।
সিমী তখনো ছোট বাচ্চাদের মত করে কাঁদছে। আমি সিমীকে দু’হাতে বুকে জড়িয়ে নিই। ওর চুলে হাত রাখি, চুলের সুমধুর গন্ধে আমার প্রাণ আরো ভরিয়ে তুলতে থাকি, সিমীর মুখটিকে আমি দু’হাতে অঞ্জলি করে নিই। ও আবেগে চোখ বুজে।
-তোমার মুখটি কি সুন্দর !
সিমী চোখ বন্ধ করে থাকে, কোন কথা বলে না। আমি ওর মুখের বাম পাশের কালো তিলটিকে নিয়ে অদ্ভুত এক খেলায় মেতে উঠি। ওতে হাত বুলাই, তিলটি আমার দিকে তাকিয়ে আছে বলে মনে হয়। ঘষে ঘষে ওর তিলটিকে আমি লাল করে দিই। তিলটিকে আমার একান্ত নিজের বলে মনে হয়। সিমীর চোখ দুটি তখনো স্বপ্নে ভাসছে। সে আমার মুখ অথবা শরীর দেখছে না, অন্য কিছু দেখছে। সে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সিমীর এই স্বপ্ন দেখা অন্ধ চোখটি আমি যুগ যুগ ধরে দেখতে পারি, এক কোটি বছর ধরে দেখতে পারি। সিমীকে আমি হাসতে বলি, কান্না থামাতে বলি। সিমী হাসে, আমার সমস্ত শরীরে ঝিলিক দিয়ে রোদ ওঠে। সিমীর ঠোঁটে আমি চুমো খাই, লক্ষ লক্ষ চুমো। চুমো খেতে খেতে বলি।
-শুধু চুমো খেয়েই আমার সাধ মিটছে না।
-তা হলে আর  কী চাও? সিমী বলে।
-এই ধর, তোমার সমস্ত রক্তে আমার রক্তের অবাধ বিচরণ।
-কি অবাক কাণ্ড এতদিন তো চুমো খেয়েই ক্ষুধা মেটাতে।
-চুমোয় মনে হয় সুখগুলো কোথাও এসে আটকে যায়, একটা কেমন বাধো বাধো মনে হয়।
-কি করতে চাও, সিমী বলে।
-তোমার আমার মাঝে কোন বাঁধন থাকবে না, থাকবে না কোন বন্ধন, কোন বসন, কোন দেয়াল।
সিমী একরাশ নিঃশ্বাস নিয়ে বিস্মিত হতে হতে বলেঃ
-সুমন তুমি কি এতটা অসভ্য হতে পারবে?
-অসভ্য কেন হতে হবে, আমি বলি।
-এই যে আমাকে ছুঁয়ে তুমি আগের মত সুখ পাচ্ছো না, জড়িয়ে ধরে সুখ পাচ্ছে না, চুমো খেয়েও সুখ পাচ্ছো না।
-হ্যা, সুখ পাচ্ছি না, আমি বলি।
সিমী মুখটাকে কাঁচুমাচু করে গম্ভীর হয়ে বলেঃ
-ঠিক আছে, আমি তোমাকে সুখ দেবো, তুমি যে ভাবে চাও সে ভাবেই।
-সেটা যদি অসভ্য ভাবে হয়। আমি বলি।
-হু সে ভাবেই।
বলতে বলতে সিমী আমাকে মাধবী লতার মত করে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে জাপটে ধরে আর আমার ঠোঁটের উপরে ওর উষ্ণ কমলার কোষের মত ঠোঁট রাখে, চুমো খায়, আমি স্বপ্নবিদ্ধ জ্যোৎস্নায় বন্যার মত ভেসে যেতে থাকি। আমার পৃথিবীতে কোন শীত নেই। আমার পৃথিবীটায় শুধু টলমল করা সুখ। আমি সেই  সুখের বাতাসে ভাসতে থাকি।
মা আমার জন্য বউ খোঁজা শুরু করে দিয়েছেন। তাছাড়া আমি লেখাপড়া শেষ করেছি, ভালো একটি চাকরিও করছি। এটাই আমার চমৎকার বিয়ের উপযোগী সময় মা’র ধারণায়। প্রতিদিন মা আমার বউয়ের খোঁজে গরু খোঁজার মত করে এপাড়া, ও গ্রাম অন্য মহল­া চষে বেড়াচ্ছেন।
-আমার সুমন কলাগাছের মত নরম, ওর জন্য কচুর পাতার মতো একটি তুলতুলে বউ আমার চাই মা বলে।
মা আমার জন্য কচুর পাতার মত একটি নরম তুলতুলে বউ খোঁজেন প্রতিদিন। আর আমিও কচুপাতাকে থোড়াই কেয়ার করে নিত্যদিন সদানন্দের মত আনন্দে দিনাতিপাত করছি। শরীরটাকে পাম গাছের মত করে নাদুস নুদুস করছি। তাছাড়া আমি জানি কচুপাতায় কখনো পানি দাঁড়ায় না। তাই কচুপাতায় মন না দিয়ে চাকরিতে মন লাগাই। নয়টা-পাঁচটা অফিস করি। অফিস থেকে ফিরে হাত মুখে পানির প্রলেপ দিয়ে খাবার টেবিলে বসি। মা আমার জন্য ভাত নিয়ে বসে আছেন কখন থেকে। আজ মাকে অন্য রকম  খুশি খুশি লাগছে বলে মনে হয়। আজ তিনি হয়ত কোন না কোন কচু পাতার মত তুলতুলে বউয়ের কথা আমাকে বলবেন যাকে মা’র হয়তো তার প্রিয় দুধ-ভাতের মত পছন্দ হয়েছে। কল্পনার ফাঁকে চেয়ে দেখি সাদা সাদা ভাতগুলো আমার দিকে কেমন হাঁ করে তাকিয়ে আছে।
-মা তুমি উসখুস না করে বলো তো কি বলবে? আমি বলি।
-বাবা, তোর জন্য খুব ভালো একটি মেয়ের খোঁজ পেয়েছি।
-তা তোমার ভালো মেয়েটি কেমন বলো তো?
মা উজ্জ্বল একটি হাসি দিয়ে ডাউস সাইজের একটি রঙিন ছবি আমার চোখের সামনে তুলে ধরে।
-মা, এতো দেখি বিশ্ব সুন্দরী, তা সুন্দরী প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছিল বুঝি?
-তোর পছন্দ হয়েছে?
-পছন্দ হবে না যা রূপ তাতে খোদ দেবতারও মন গলে যাবে। আর আমি তো কোন হাড় হদ্দ।
মা আমার কপালে কচুপাতার পট্টি বাঁধার জন্য বিশ্রামহীন নিদ্রাহীন ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। দিন গুনে গুনে দ্রুততার সাথে সময়টা কিভাবে পার হয় তা ঠিক বুঝতে পারি না। বাবা-মা আমাকে বিয়ে করানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। এদিক সেদিক শত সহস্র ঘোরাঘুরির পর বউ একটি মিলেও গিয়েছে। লম্বা গোলগাল, সুন্দরী, মিষ্টি চেহারার বউ। আমি ব্যস্ত আছি চাকরি আর গোপনে আংটি বদল করা মানস প্রতিমা সিমীকে নিয়ে। সিমী প্রতিদিনই আমার বুকে মুখ রাখে, হাসে, কাঁদে, স্বপ্ন বুনে। সুখে ভাসে। আমার মানস প্রতিমা আমার উপর খুশি থাকলেও ভাগ্যদেবী আমার সুখে খুশি হতে পারে না। অথবা ভাগ্যদেবী আমার সুখে হিংসা করে কি না তাও ঠিক বুঝি না। বাবা-মা আমার বিয়ের প্রায় সবকিছুই তৈরি করে ফেলেছেন। বিয়ের দিনক্ষণ তারিখ, এমনকি জুয়েলারি থেকে শুরু করে শাড়ি, স্নো, পাউডার এটা-ওটা সবকিছুই কিনে ফেলেছেন। বিয়ের কার্ডও রেডি করে রেখেছেন। বিয়েতে আমি মত দিই না। আমার বিয়ের সানাই বাজবে অথচ আমি জানি না। ভেবে আমি আশ্চর্য হই। বউ কেমন হবে, আমার মনের মত, নাকি গতানুগতিক, তাও জানি না। আর জেনেই বা কি হবে। যেখানে আমার নিজস্ব মতামতের কোন মূল্যই নেই, সেখানে আমার কী করার আছে। আমি যাকে নিয়ে সারাটি জীবন কাটিয়ে দেবো তাকে আমি দেখবো না, জানবো না। ঘর বাঁধবো আমি, অথচ আমার পছন্দ-অপছন্দের কোন মূল্যই নেই। অবাক লাগে আমার, ভাবতে কষ্ট লাগে আমার। আমার বুকের মাঝে কষ্টগুলো চিনচিন করে ওঠে। আমি কি করবো বুঝি না। বুঝেও কিছু করতে পারি না। একদিকে বাবা-মা’র পছন্দ করা মেয়েটিকে বউ করার জন্য, বাবা-মা’র পছন্দকে মূল্য দেয়ার জন্য, আমার মাথার উপর ঝুলছে ফাঁসির দড়ি। অন্যদিকে আমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে জানতে পেরে সিমী বিষ খেয়ে পড়ে আছে হাসপাতালের নির্জন বারান্দায়।
সিমীর মৃত্যুর সংবাদ সারাটি গ্রাম ছড়িয়ে পড়ে। আমার বুকের পাঁজর ভেঙে খান খান হয়। হাসপাতালের সামনে মানুষের ভিড়। ভিড় ঠেলে কেউ একজন সিমীর লাশ দেখে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। কেউ একজন বলে ওঠেঃ
-পৃথিবীতে ভালবাসা বলে কী কিছুই নেই? সিমী সুমনকে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করল?

 

আমার কান্নাগুলো চুইয়ে চুইয়ে পড়ে হাসপাতালের বারান্দাটা নোংড়া হয়। বর্ষার বানের মতো কষ্টে আমার মনটা প্লাবিত হয়ে যায়। আমার সামনে এখন কোন সূর্য নেই, কোন আলো নেই, স্বপ্ন নেই। একরাশ অন্ধকার, গুচ্ছ গুচ্ছ অন্ধকার এখন ছেয়ে আছে আমাকে।
Facebook Comments Box
Website | + posts

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

মিকি মিডিয়া লিমিটেডের একটি প্রতিষ্ঠান। © ২০২৪ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
প্রযুক্তি সহায়তায় Rudra Amin