আগামীকাল ৩৬জুলাই তোমার পতন হবে
রি হোসাইন
❑
আগামীকাল ৩৬এ জুলাই ……
তোমার সাথে আমার দেখা হবে…
সামনাসামনি…..
সকল ব্যারিকেড, কার্ফিউ আর
তোমার মাস্তানদের রক্তপিপাসা মিটিয়ে দিয়ে হলেও
পুলিশের ফ্যাকাশে পোশাক রঙ্গিন হয়ে যাবে তবুও
তোমার সাথে আমার দেখা হবে…
হবেই ….
একদম সামনাসামনি…..
তুমি নিশ্চিত থাকো, আমি তোমাকে হত্যা করবো না,
আমি রক্তলিপ্সু নই …
কোন প্রশ্নও করবো না
তোমার সমস্ত উত্তর বুলেটের বারুদে ভরে
তুমিতো আগেই দিয়েছো …
এমনকি, তোমাকে কান্নার সুযোগও দেবো না…
তোমার কান্নার অভিনয়ে কুমিরেরাও যে লজ্জা পেয়ে যায়
তারপর
তোমার মিথ্যার পাহাড়
আমার চোখের আগুনে ছাই হয়ে যাবে
তোমার চকচকে জিভের বিষ
আমার নি:শ্বাসের ঝড়ে স্তব্ধ হয়ে যাবে
আমার রক্তের স্রোতে
তোমার পায়ের তলার মাটি ভেসে যাবে
আমার সামনে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে তুমি
তোমার তন্ত্রমন্ত্রের সকল খেলা শেষ হয়ে যাবে
আগামীকাল ৩৬এ জুলাই
তোমার পতন হবে….. চুড়ান্ত পতন
আগামীকাল আমি তোমার সামনাসামনি
সিনা টান টান করে দাঁড়াবো যখন…
হে, খায়রুল হক
রি হোসাইন
❑
আ-ত্মহ-ত্যার প্ররোচনাকারী হিসেবে আমার বিচার হবে
হোক!
হে বিচারপতি, তবুও তোমার নিজের হাতেই
তোমার বিচার হোক
তুমি আমার ভোটের অধিকার হ-ত্যা করেছো
তোমার নিজের হাতেই তোমার ফাঁ-সি হোক
তুমি ঝুলে পড়ো নায়লনের দড়িতে
ফাঁ-স নাও বেডরুমের ফ্যানে ঝুলে
না, না, বাথরুমের শাওয়ারে
তোমার মৃ-ত্যু হোক সর্বোচ্চ অসম্মানে…
তোমার প্রতি কোন সম্মান অবশিষ্ট নেই
কোন নাগরিক, কবি, ডাক্তার, মাওলানা, হকার কিংবা বেশ্যা
তোমার প্রতি সম্মান নেই কারোই…
এক ফোঁটাও
এমনকি ক্যান্টনমেন্টের দেয়ালে যেখানে পেচ্ছাব করে মানুষ
সেখানেও কেবল তোমার নামে ঘৃণা ছাড়া কিছু নেই
হে, খায়রুল হক,
আমি তোমাকে আ-ত্মহ-ত্যার পরামর্শ দেবো
হে অমানুষ বিচারক
আমি তোমার ফাঁ-সির রায় দেবার হক
তোমাকেই দেবো, তারপর
আ-ত্ম-হ-ত্যার প্ররোচনাকারী হিসেবে আমার বিচার হবে
হোক!
তীব্র নিন্দার খেলা ( জাতিসংঘের প্রতি )
রি হোসাইন
❑
আমি মরছি…
আর তুমি নিন্দা জানাচ্ছো
তীব্র নিন্দা…
তীব্র থেকে তীব্রতর…
আর আমি, মরছি আর মরছি
গুলিতে, বুটের তলায় পিষে
মৃত্যু সংখ্যার সাথে সাথে তোমার নিন্দার তীব্রতা বাড়ছে
তোমার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় অনুপ্রাণিত হয়ে
মৃত্যুর সংখ্যা আরও, আরও বাড়ছে
আরও বাড়ছে তোমার নিন্দার তীব্রতাও
এ এক খেলা
নিন্দা আর মৃত্যুর
কিন্তু এ খেলায় পরাজয় তোমারই হবে
একদিন মরতে মরতে আমরা সব মরে যাবো
তারপর মৃত্যুর জন্য কেউ থাকবো না
তোমার নিন্দার তীব্রতাও আর বাড়বে না
কৌতুক
রি হোসাইন
❑
এক পকেট বিক্ষোভ নিয়ে
অনুমতির অপেক্ষায়…
বসে আছি
সাজানো বুট থপথপে চেয়ে আছে,
জড়ো করে রাখা রাইফেল,
বুলেটের ভাণ্ডার যার পাশেই,
যেখানে রক্ত, বমি আর পায়খানা
তারা আমাকে দেখে হাসছে…
আর, এক কলম বিদ্রোহ নিয়ে
আমি মিনমিন করে কবিতা লিখি
আমি জানি না
কবিতা লেখার অধিকার
আমাকে কে দিয়েছে?
নিখোঁজ
রি হোসাইন
❑
যাদেরকে পাওয়া যায়নি
যাদেরকে পাওয়া যাবেনা
এমনকি লা-শও না
শার্টের একটা বোতামের আধপোড়া অংশ ছাড়া
একটা ভ্যানের জ্বলে যাওয়া স্পোকের শেষাংশে
আর কিছু মিলে না
এমনকি গায়ের গন্ধও না
যাদেরকে পাওয়া যায়নি
যেনো চেটেপুটে খেয়ে, পালিয়েছে পিশাচিনী
জুতা
রি হোসাইন
❑
যখন মানুষের ভিড় দেখি
তাদের জুতোর দিকে তাকাই
কি অদ্ভুত সব জুতা..
কোন কোনটা পায়ের চেয়েও বড়
কোন কোনটা পায়ের চেয়েও সুন্দর
অনেক সুন্দর পা দেখি জুতা ছাড়াই
অনেক সমৃদ্ধ পা দেখি ছেড়া জুতোয়
অনেক হতাশার জুতা দেখি
কোনটা আবার গর্বিত পরিপাটি
বাবাদের চটি ক্ষয়ে যাওয়া মলিন চপ্পল
রাজকন্যার হাইহিল দেখি
মায়েদের গুলো খুব দু:ষ্প্রাপ্য হয়
শুনেছি সেখানেই নাকি বেহেশত থাকে..
দীর্ঘদিন কালি না করা বেকারের
ভাজ পড়া ময়লা জুতা
আত্মহত্যার পথে হেটে চলা এলোমেলো পা
দেখি শ্রমিকের গোড়ালি ফাটা পায়ের বিষন্ন চিত্রকর্ম
প্রেমিক প্রেমিকার স্বপ্নিল পথচলা দেখি
চুরি যাওয়া বরের নাগড়া
শিশুদের ঈদের নি:ষ্পাপ জুতা;
কি সুন্দর তার ঘ্রাণ
খুব অবাক হয়ে দেখি
উজাড় করে দেয়া খেলোয়াড়ের
বৃদ্ধাঙ্গুল ছেড়া জুতা
জেল থেকে ছাড়া পাওয়া নেতার কোলাপুরি
ফেরারি গনতন্ত্রির পলাতক যুথুবুথু জুতা
ভয়ধরা থপ থপ হিংস্র বুটের উদ্ধত তান্ডব দেখি
আমলার ঝা চকচকে আয়নার মতো
দেখি প্রেসিডেন্টের ভাবলেশহীন জুতা
যেমন দখি দম্ভের
আবার দেখি
ফিতা ছেড়া শত সেলাইয়ের…
অত্যাচারীর জুতার সাথে সাথে
দেখি নিপিড়ীতের নির্জীব জুতা
দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে যাই
তবু সবার পায়ের দিকে তাকাই,
তীব্র আকাঙ্ক্ষার চোখ খুঁজে বেড়ায়
এমন একটা জুতা…
সেটা হলো,
শুন্যে ছুড়ে দেওয়া বিদ্রোহের জুতা
জুলাই বিপ্লবের লেখা কবিতা ৬টি বাছাই করা কবিতা (১টি ছাড়া সব গুলোই ৫ই আগস্ট বা ৩৬এ জুলাই- নিখোজ কবিতাটি ৫ তারিখ সাভার গনহত্যার পরে লেখা)
কবি রি হোসাইন জীবনের পথে সংগ্রামী কবিতার কবি। তিনি বাংলা সাহিত্যে একজন বিদ্রোহী এবং সংগ্রামী কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিত। তাঁর কবিতায় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, সমাজের নানা দ্বন্দ্ব এবং সামাজিক বৈষম্য গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়। রি হোসাইনকে নিয়ে আলোচনা করতে হলে প্রথমেই তার জীবনের প্রেক্ষাপট এবং লেখালেখির প্রাথমিক স্তরগুলোতে নজর দিতে হবে, যা তাকে একজন পরিণত কবি হিসেবে তৈরি করেছে।
প্রাথমিক জীবন ও লেখালেখির শুরু রি হোসাইনের জন্ম ১৯ আগস্ট, রংপুর জেলার নিউ সেনপড়ায়। তার পিতার আদি নিবাস বিক্রমপুরের মুন্সিগঞ্জের লৌহজং থানার মসদগাও গ্রামে। জন্মসাল নিয়ে কিছু বিতর্ক থাকলেও, তার পাসপোর্ট অনুযায়ী জন্মসাল ১৯৮১ এবং সার্টিফিকেট অনুযায়ী ১৯৮০। তার শৈশব এবং কৈশোরের পরিবেশে দেখা পাওয়া যায় এমন একটা জটিল সমাজের প্রেক্ষাপট, যেখানে অবিচার, বৈষম্য এবং অধিকারহীনতা ছিল তার নিত্যসঙ্গী। সেই অভিজ্ঞতাগুলো তার কবিতায় বারবার উঠে এসেছে। রি হোসাইনের কবিতার যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৯৩ সালে, যখন তার প্রথম কবিতা ‘এই বর্ষায়’ রংপুরের স্থানীয় পত্রিকা ‘যুগের আলো’ থেকে প্রকাশিত হয়। এরপর ধীরে ধীরে তিনি নিজেকে সাহিত্য জগতে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং তার লেখায় সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, নিপীড়িত মানুষের কষ্ট এবং স্বৈরাচারী সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ প্রতিফলিত হতে থাকে।
কবিতায় প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ রি হোসাইনের কবিতা যে কোনও সাধারণ কবিতার মতো নয়; এটি বিদ্রোহের শাব্দিক প্রতিরূপ। তার রচনা বিশেষত ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশের কোটা এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। তার কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতার অভ্যুত্থান চাই’ ২০২৪ সালের আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। এই গ্রন্থের ‘বিদ্রোহে’ শিরোনামের কবিতাটি ছিল আন্দোলনের প্রেরণা, যেখানে প্রথম শহীদ আবু সাঈদের কথা উঠে এসেছে।
রি হোসাইন এমন একজন বিরল কবি যিনি জীবন হাতে নিয়ে এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন, প্রতিদিন আন্দোলনে বের হওয়ার আগে তার স্ত্রীর কাছে ব্যাংকের সমস্ত তথ্য এবং মৃত্যুর পর তার যা করণীয় সে বিষয়েও স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়ে যেতেন। তার কবিতায় বারবার বিদ্রোহের মূর্ছনা উঠে আসে। ‘আমাকে শোকে ধরেছে’, ‘বিবর্তন’, ‘ঝাপটা বাতাসের গান’—এগুলো এমনই কিছু কবিতা যেখানে শোক, সংগ্রাম, পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা এবং প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিপ্লবের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। রি হোসাইনের কবিতায় মৃত্যু, ধ্বংস এবং পুনর্জন্মের মতো বিষয়গুলো অত্যন্ত জোরালোভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
সাহিত্য ও জীবনবোধ রি হোসাইন তার সাহিত্যকে বাতাসের মতো ভাবেন—যা প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসে অনুভব করা যায়। তার সাহিত্যচর্চা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত উপভোগের জন্য নয় বরং সমাজে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য। ২০১৪ সালে তার বিদ্রোহী লেখালেখির কারণে এনএসআই বা ডিজিএফআই-এর কাছে হাজির হয়ে মুচলেকা দিতে হয়। কিন্তু তবুও তিনি থেমে থাকেননি। তার প্রবন্ধ ‘জিয়ারত’ এবং অন্যান্য রচনাগুলোতে মৃত্যু, শোক এবং জীবনের মূল্যবোধ নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা উঠে এসেছে। ২০২৪ সালের জুন মাসে লেখা তার দুটি কবিতা—‘কাপুরুষের মা’ এবং ‘দুর্বৃত্ত’ —ভারত বিরোধী মনোভাব প্রকাশের জন্য তিনি বারবার হুমকির সম্মুখীন হন। তবুও তিনি সাহিত্যের পথ থেকে সরে যাননি। তার জীবন যেমন সংগ্রামের, তেমনি তার লেখালেখিও রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটকে গভীরভাবে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘মানুষেরা আমাকে প্রত্যাশা করেনা’ কিন্তু তার সাহসী কণ্ঠস্বর বারবার প্রমাণ করে দেয় যে তিনি এই সমাজের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
শেষ কথা রি হোসাইন একজন সংগ্রামী কবি, যার কবিতা মানুষের মনকে জাগ্রত করে এবং সমাজের অসংগতি, অবিচার, এবং বৈষম্যকে প্রকাশ্যে আনে। তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং সাহসী অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। তার কবিতায় শোক, প্রতিবাদ, প্রেম, এবং সমাজের প্রতি গভীর দায়বদ্ধতা মিশে থাকে।