১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিশ্ব ইতিহাসের এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। বিশ্ব-গণ মাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল এই মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের বীরত্ব, আত্মত্যাগ, সাধারণ মানুষের বাঁচার সংগ্রাম, স্বৈরাচারী পাক সামরিক বাহিনীর নির্মম নৃশংসতা বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় নির্ভীকতার সাথে পরিবেশিত হয়েছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক উপাদান হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের পত্র-পত্রিকা প্রামাণ্য দলিল হিসাবে সমাদৃত।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চায় কম আলোচিত বিষয়গুলির মধ্যে অন্যতম ছিল একাত্তরে দেশের অভ্যন্তরে ও মুজিবনগর সরকার থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার আলোচনা। যার নির্যাস ও নানা অজানা তথ্য ও প্রকাশিত খবর প্রাসঙ্গিক আলোচনায় তুলে ধরতে এই গবেষণার প্রয়াস। প্রাসঙ্গিক আলোচনা যেহেতু ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ তাই পটভূমির ক্ষেত্র নির্ধারণে খুব বেশী না এগিয়ে আমরা ১৯৭০ এর মুক্তিযুদ্ধ তাই পটভূমির ক্ষেত্র নির্ধারণে খুব বেশী না এগিয়ে আমরা ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনকেই বেছে নেব।
১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ৬ জানুয়ারি মুজিবুর পুনরায় আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১ এপ্রিল লীগের কার্যকরী পরিষদের সভায় নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিন্ধান্ত গৃহীত হয়। ৭ জুন রেসকোর্সের ময়দানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু ৬ দফার প্রশ্নে আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত করার জন্য দেশবাসীকে আহ্বান জানান। ৬ দফার মূলদাবীর মূল বক্তব্য ছিলঃ (১) পাকিস্তানকে একটি ফেডারেল রাষ্ট্রে পরিণত করা, (২) প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয় ছাড়া আর সব ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকবে, (৩) পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তান দুটি পৃথক ও সহজ বিনিময়যোগ্য মুদ্রা থাকবে, (৪) সব ধরনের কর ও শুল্ক ধার্য ও আদায় করার দায়িত্ব প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকবে, (৫) দুই অঞ্চলের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা আলাদা হিসেব থাকবে, (৬) পূর্ব বাংলার প্রতিরক্ষা ঝুঁকি কমানোর জন্য এখানে আধা সামরিক বাহিনী গঠন ও নৌবাহিনীর সদর দপ্তর স্থাপনের দাবি জানানো হয়।১ ১৭ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু তাঁর দলের নির্বাচনী প্রতীক হিসাবে ‘নৌকা’ প্রতীক পছন্দ করেন এবং ঢাকার ধোলাই খালে প্রথম নির্বাচনী জনসভায় নির্বাচনী প্রচার কাজে সরকারী বক্তব্য রাখেন। ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। আওয়ামী লীগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন লাভ করে।২
নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায় জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন পেয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে বিবেচিত হয় আওয়ামী লীগ। প্রাদেশিক পরিষদেও আওয়ামী লীগ নিরুঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। নির্বাচনের ফল অনুসারে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের বৃহত্তম দলের স্বীকৃতি পায় এবং জুলফিকার আলি ভুট্টোর পিপিপি দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে এবং জাতীয় পরিষদে প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা পায়। ইয়াহিয়া খান ১১ ডিসেম্বর ১৯৭০ এক বিবৃতির মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অভিনন্দন জানান এবং দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে দেন।৩ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিব টেলিগ্রামের মাধ্যমে ইয়াহিয়ার অভিনন্দনের পরিপ্রেক্ষিতে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।৪
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাতপর্যপূর্ণ সময়। ৩ জানুয়ারি রেসকোর্সের ময়দানে মুজিবুর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শপথ গ্রহণ পরিচালনা করেন। ৫ জানুয়ারি পাকিস্তান পিপলস্ পার্টির নেতা ভুট্টো কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের সাথে কোয়ালিশন সরকার গড়ার প্রস্তাব দেন। ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের বৈঠক আহ্বান করেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো তা বয়কটের ঘোষণা করে দুই প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দুই দলের প্রতি ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবি জানান।৫ এই সময় পূর্ব বাংলায় শেখ মুজিব ও পাকিস্তানে ভুট্টো প্রতিনিয়ত সভা-সমাবেশ, সংবাদ সন্মোলনে ৬ দফার পক্ষে ও বিপক্ষে প্রচার চালান। যেসব জাতীয় পরিষদ সদস্য ঢাকার অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন ভুট্টো তাদের উপর বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখেন।৬ চাপের কারণে ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ ১৯৭১ অনির্দিষ্টকালের জন্য অধিবেশন মুলতুবি ঘোষণা করেন।৭ ২ মার্চ মুজিবুর সমগ্র প্রদেশে হরতালের ডাক দেন।৮ ৩ মার্চ মুজিব বলেন ৭ মার্চ পরবর্তী কর্মসীচি ঘোষণা করা হবে।৯ এই প্রসঙ্গে Farman Ali-র বক্তব্য উত্থাপন করা যায় – Farman Ali claims that he requested to speak privately to Yahya in order to dissuade him from a confronation with Mujib but he failed. When he got upto leave at the end of the interview, Yahya told him “I am not afraid of myself. West Pakistan in my base, I have to look after it.”১০
বঙ্গবন্ধুর দাবি অনুযায়ী ৫ মার্চ সামরিক কর্তৃপক্ষ সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। লেখক, বুদ্ধিজীবী ও পূর্ব বাংলার সরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতি শেখ মুজিবের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানায়। এদিন সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টো পর্যন্ত হরতাল পালিত হয়। বিকালে লেখক-লেখিকাদের এক বিক্ষোভ মিছিল বের হয়।১১ ৩ মার্চ বাংলা একাডেমীতে বেতার, টিভি, চলচ্চিত্র ও অঙ্কণ শিল্পীদের এক সভা হয়। মুজিবুর রহমানের বাসায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক কার্যকারী কমিটির যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়।১২
বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস ৭ মার্চ এক অনন্য দিন। এদিন রেসকোর্সের জনসভা থেকে শেখ মুজিব স্বাধীনতার ডাক দেন এবং অসহযোগ আন্দোলনের পরবর্তী আরও এক সপ্তাহের কর্মসূচি ঘোষণা করেন।১৩ ৭ মার্চের জনসভা সম্পর্কে ‘সংবাদ’ পত্রিকায় ৮ মার্চ লেখা হয় – ‘রেসকোর্সের বিক্ষুদ্ধরূপে যেন গোটা পূর্ব বাংলা উপস্থিত। ইহাদের অনেকেই যেন গ্রাম-গঞ্জের সুদূর জায়গা হইতে আসিয়াছেন। মাইলের পর মাইল পথ অতিক্রম করিয়া আসিয়াছেন তাহারা রেসকোর্সের ময়দানে, তাঁহারা আসিয়াছেন মিছিল করিয়া, একের পর এক মিছিল। কৃষকের পর জেলে, ছাত্রের পর কেরানী, শিক্ষকের পর শ্রমিক আর ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নিয়ে গৃহবধুদের মিছিল।১৫ ৭ মার্চের রেসকোর্সের ভাষণের পর ৮ মার্চ সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার ৯৮ জন প্রতিনিধি এক জরুরী সভায় শেখ মুজিব ঘোষিত কর্মসূচীর প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন।১৬ ১০ মার্চ দৈনিক পাকিস্তানে ক্ষমতা হস্তান্তর বিষয়ক খবর ছাপা হয় এই শিরোনামে ‘আর দেরী নয়’ বলা হয় অবিলম্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক।১৭ ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ক্লাবে শিক্ষক সমিতির সভাপতি এ. বি. এম. হাবিবুল্লাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভা শেখ মুজিবের অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে ১১ মার্চ ছাত্র ইউনিয়নের আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচি ছিল জনগণের অংশগ্রহণে গণবাহিনী গড়ে তোলা ও কর্মীবাহিনীকে নিয়মিত প্যারেড অনুষ্ঠান করানো।১৮ ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ থেকে ১৪ মার্চ পর্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায় এবং সাফল্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
১৫ মার্চ ১৯৭১ ইয়াহিয়া খানসহ কয়েকজন জেনারেল কঠোর সাময়িক প্রহরায় ঢাকায় আসেন, ১৩ মার্চ থেকে মুজিবের সাথে আলোচনা শুরু হয়। ‘Pakistan Observer’ লেখে ‘Wisdm dictates that whatever the politicians and leaders decide as to the future of their country one thing has to be kept in mind, …. Shikh Mujib and the responsible Awami League Leadership have repudiated violence and all people in their Senser should support them’১৯, ১৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়া-মুজিব আলোচনা শুরুর পর সমগ্র পাকিস্তানসহ সারা বিশ্বের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় সেদিকে প্রথম দিনের প্রায় আড়াই ঘন্টা আলোচনার পর মুজিব সাংবাদিকদের বলে, আলোচনা অব্যাহত থাকবে। অল্প সময়ের আলোচনায় সব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।২০ ২২ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতির উদ্দেশ্য এ এক ভাষণ দেন, ভাষণে জাতীয় পরিষদের আসন্ন অধিবেশনে মুলতবি ঘোষণা করেন। ২২ মার্চ ঢাকার ইয়াহিয়া ও ভুট্টো বিরোধী স্লোগান চলতে তাকে। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে দিয়ে অসংখ্য মিছিল পরিক্রমা করে। বাংলা একাডেমীতে স্বৈরাশাসক বিরোধী কবিতা আবৃত্তি হয়। মুজিবুর রহমান বিগত ২১ দিনের অসহযোগ আন্দোলন সুশৃঙ্খল ও নিষ্ঠার সাথে পালনের জন্য জনগণকে অভিনন্দিত করেন।২১ শেখ মুজিব যে কোন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।২২ ১৬-২৪ মার্চ, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ইয়াহিয়া মুজিব আলোচনার অন্তরালে সরকার পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রচুর সংখ্যক সৈন্য এনে বাংলাদেশের সেনানিবাস গুলি ভর্তি করে। ২৫ মার্চ রাত ৯টার পর ঢাকা হাইকোর্টের মোড় ও আশেপাশের এলাকায় গোলাগুলির শব্দ হয়। জনৈক ব্যক্তি টেলিফোন ‘দৈনিক বাংলা’ অফিসে জানান ৯৬ ট্রাক ফোর্স ক্যানমেন্ট থেকে শহরে ঢুকছে। এর পর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। রাত ১২টা পেরিয়ে যেতে হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভেঙে গর্জে ওঠে মেশিনগান। চারদিক আলোকিত করে ছোটে রঙ-বেরঙের ম্যাগনেশিয়াম ফ্ল্যাশ। ঘরে ঘরে তখন তীব্র হাহাকার, রাস্তায় জমছে তখন লাশের স্তূপ।২৩ ২৫ মার্চ ‘দৈনিক বাংলা’য় রাজারবাগের নৃশংসতা বর্ণিত হয় এভাবে – ‘ভোর পাঁচটা’। রক্তাক্ত সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়লো এখানে ওখানে। শত শত বাংলার প্রাণ সেই সূর্যের আলোয় শুয়ে আছে। আর বাঙালি পুলিশের লাশ টেনে হেচড়ে স্তূপীকৃত করা হলো এখানে সেখানে। পেট্রোল ঢেলে সে লাশে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।২৪ ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলেও আক্রমণ চালায়। কিন্তু ছাত্রীরা সেদিন সেখানে ছিল না, তাই হতাহত হয়নি। ২৫ মার্চ রাত ১১টার দিকে এয়ারফিল্ড থেকে সৈন্যবাহিনীর এই গাড়িবহর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের জন্য রওনা হয়। বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেনঃ “The may be last messages from today Bangladesh is Independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might you might he and with whatever you have to resist the army of occupation to the last your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and Final Victory is achived.”২৫ (অনুবাদঃ এটাই হয়তো আমার শেষবার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশে স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ, তোমরা যে যেখানেই আছো এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সৈন্যবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহ্বাব জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতারিত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুধ চালিয়ে যেতে হবে।) এই ঘোষণা, বাংলাদেশের সর্বত্র ওয়ারলেস, টেলিফোন, টেলিগ্রামের মাধ্যমে প্রেরিত হয়। এর সাথে তিনি বাংলায় নিম্মলিখিত একটি ঘোষণা পাঠানঃ তা হলো – পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা ই.পি. আর. ঘাঁটি রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের রাস্তায় যুদ্ধ চলেছে, আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। ….. কোনো আপোষ নাই। জয় আমাদের হবেই। পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শ্ত্রুকে বিতারিত করুন। সকল আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক প্রিয় লোকদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।২৬ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা প্রচারিত হয় গভীর রাতে। স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার অপরাধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাত ১টা ৩০মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা নিয়ে যায় এবং ২৬ মার্চ গভীর রাতে তাকে বন্দি অবস্থায় পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। ২৬ মার্চ, জেনারেল ইয়াহিয়া এক ভাষণে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী বলে অ্যাখায়িত করেন”।২৭
২৬ মার্চ চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম. এ. হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। The Statesman কাগজে শিরোনাম হয় – ‘Bangladesh declares Independence’ …… খবরে লেখা হয় – ‘Sheikh Mujibur Rahaman tonight proclamimed East Pakistan a Sovereign Independent People’s Republic of Bangladesh.’২৮
মুক্তিযুদ্ধের গর্ব মুজিবনগর এই মুজিবনগরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার। ১০ এপ্রিল মেহেরপুর বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে গঠিত হয় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার। বৈদ্যনাথতলার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মুজিবনগর। পাকিস্তানি কারাগারে বন্দি জনতার নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে গঠিত হলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বাঙালির রাষ্ট্র গঠিত হলো – যার স্বপ্ন – অভিযাত্রায় অনন্য পুরুষ শেখ মুজিবুর রহমান, অধ্যাপক ইউসুফ পাঠ করেন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র।২৯
বেতার ভাষণটি ‘সাপ্তাহিক বাংলাদেশ’ (৩) পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এভাবে – ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়েছে, সেই সরকারের কয়েকজন শীর্ষ স্থানীয় উপদেষ্টার নাম আমি দেশবাসীর সামনে পেশ করছি বাকী উপদেষ্টার নাম পরে ঘোষণা করা হবে। প্রেসিডেন্ট – বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান, ভাইস প্রেসিডেন্ট – এস. নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহম্মদ, মন্ত্রীসভার সদস্য খোন্দকার মোশতাক আহমেদ, জনাব কে. এম. মুনসুর আলী, জনাব কামরুজম্মান। …… পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার দস্যু বাহিনীর বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ আপনারা গড়ে তুলেছেন তা এমন এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে যে পৃথিবীর সমস্ত স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে আপনাদের এই অভূতপূর্ব সংগ্রাম সর্বকালের প্রেরণার উৎস হয়ে রইবে। আপনাদের অদম্য সাহস ও শক্তি যা দিয়ে আপনারা রুখে দাঁড়িয়েছেন ইয়াহিয়ার ভাড়াটে দস্যুদের বিরুদ্ধে তার মধ্য দিয়ে আপনারা এটাই প্রমাণ করেছেন যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জন, অনেক রক্তপাতের ফলে এঁকো নতুন বাঙালি জাতি জম্ম নিল।৩১
১৭ এপ্রিলের ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন আহমেদ সেই ভবেরপাড়া জায়গার নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘মুজিবনগর’ এবং বঙ্গবন্ধুর নামে ঐ সরকারের নামকরণ করেন মুজিবনগর সরকার।৩২ সেই থেকে বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাজধানী হিসাবে মুজিবনগরকে স্বীকৃতি দেওা হয়। স্বাধীনতা প্রিয় বাঙালির হৃদয় মানসে চিরস্থান পায় মুজিবনগর। স্বাভাবিকভাবেই মুক্তিযুদ্ধের দায়িত্ব অর্পিত হয় এই সরকারের উপর।
মূলত ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয় বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতার চূড়ান্ত লড়াই। ‘জয়বাংলার’ প্রতিবেদন লেখা হয় – ‘সারা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ মুক্তিসংগ্রামের জয় পতাকা হাতে নিয়ে যুদ্ধ করছেন পশ্চিম পাকিস্তানী দস্যু ইয়াহিয়া জঙ্গিজোটের বর্বর সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে …. বাঙলার মাটিতে সোনা ফলে। কিন্তু আজ সেই মাটি মেহনতী বাঙালীর রক্তে সিক্ত। …. সারা বাংলাদেশের আজ শুধু এক আওাজ – হুঁশিয়ার ! হুঁশিয়ার ! বাংলাদেশের স্বাধীনতা তোমরা রুখতে পারবে না।৩৩
পাকিস্তানী বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের বহু নারী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল, ‘জয়বাংলা’ (৩) এই ধরনের এ একটা খবর প্রকাশিত হয় – ‘গত ২৯ জুন মৌলভাজার মহকুমা শাস্তি কমিটির চেয়ারম্যান ও কাউন্সিল মুসলিম লীগের মিসির উল্লার সুন্দরী যুবতী মেয়েকে পাক বাহিনীর সৈন্যরা ধরে নিয়ে নির্মমভাবে পাশবিক অত্যাচার করে। পরে মেয়েটি কলঙ্কের গ্লানি থেকে অব্যাহতি লাভের জন্য আত্মগত্যা করেছে বলে জানা গেছে।৩৪ জয়বাংলা (৩) এ আরো প্রকাশিত হয় – ‘মেজর খালেদ বলেছেন, পাক বাহিনী বাঙালী মেয়েদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালাচ্ছে এবং তাদের শ্লীলতাহানি করছে।৩৫
গণবাহিনী ছাড়াও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আরো অনেক অনিয়মিত গোরিলা বাহিনী গড়ে ওঠে। যারা পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। ১ লা আগস্ট ভালুকা থানার অন্তর্গত চানপুর ও সোনাখালির মাঝখানে মুক্তিবাহিনী পাক বাহিনীকে অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। এই অতর্কিত আক্রমণে পাক সেনারা “কিয়া মুছিবত হ্যায়। কিয়া মুছিবত হ্যায়” বলে বিকট চিতকার করে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে শুরু করে। মুক্তি বাহিনীর গুলিতে ১৪জন পাকসেনা নিহত ও ৩জন আহত হয়।৩৬
আগষ্ট মাসের দিকে মুক্তিবাহিনী সংগঠিত হয়ে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সারা বাংলাদেশ জুড়ে গেরিলা ও নিয়মিত পদ্ধতিতে পাক সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। বাংলাদেশে খবর প্রকাশিত হয় – ‘গত বিপ্লবী ২১শে জুলাই রংপুর জেলার জয়দারা নামক স্থানে মাইন বিষ্ফোরণের ফলে ১টি সাজোয়া গাড়ী বিধস্ত হয় এবং ১৫ জন পাকসেনা প্রাণ হারায়। এছাড়া বিভিন্ন থানার উপর আক্রমণ চালিয়ে মুক্তি ফৌজের গেরিলা বাহিনী গত সপ্তাহে শুধু রংপুর জেলাতেই ৩২ জন পুলিশকে হত্যা করে।
‘জয়বাংলা’ (১) পত্রিকায় প্রকাশিত হয় – ‘গত ১৭ আগষ্ট মুক্তিযোদ্ধার ছুটিপুরে দখলকার বাহিনীর একটি ঘাঁটির উপর তিন ইঞ্চি মর্টার দিয়ে আক্রমণ চালিয়ে ১৫ জনকে খতম করে, এই আক্রমণে শত্রু সেনার ঘাঁটি সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয় …. বিলম্ব প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, দখলদার বাহিনী গত ১৪ আগষ্ট তথাকথিত ‘আজাদী দিবস’ পালনের লক্ষে আমাদের বীর যোদ্ধারা রাজশাহীর নবাবগঞ্জে পাকিস্তানী সৈন্য বাহিনীর সদর দপ্তরের উপর আক্রমণ করে দপ্তরটি বিধ্বস্ত করে দেয়। এ আক্রমণে খান সেনাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।৩৮
বাংলাদেশের নৌবাহিনী মুক্তিযুদ্ধে বিরাট সাফল্য পায় – ’২১ আগষ্ট বাংলাদেশে, গত এক সপ্তাহে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর মুক্তিবাহিনী ২১ খানা পাক সামরিক বাহিনীর অস্ত্র এবং অন্যান্য সামগ্রী বোঝাই জাহাজ মাইন বিসাফোরক ধ্বংস করে দিয়েছেন, এতে প্রায় দুই শতাধিক সৈন্য মারা পড়েছে’।৩৯
‘সাপ্তাহিক বাংলা’ পত্রিকা ‘স্বীকৃতি নাই বা হোক, বাংলাদেশ স্ব-প্রতিষ্ঠিত হবে’ খবরে বলা হয় – ‘স্বীকৃতি চাই না। স্বীকৃতি ছাড়া বাংলাদেশের মানুষ তাদের মাতৃভূমি থেকে হানাদার বাহিনীকে নির্মূল করে দিয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত হবে’।৪০ দিল্লীতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য আবেদন করা হয়। ‘সাপ্তাহিক বাংলা’ লেখে – ‘বাংলাদেশে সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সমাপ্তি দিবসে ২৫টি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা গত ২০ সেপ্টেম্বর যে রিপোর্ট পেশ করেছেন তাতে বিশ্বজননীতার ভিত্তিতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ও তার ন্যায়সঙ্গত সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতিদানের সুপারিশ করা হয়েছে।৪১
জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রশ্নে বিভিন্ন শক্তশালী রাষ্ট্রগুলি যে বক্তব্য দিয়েছে তা ‘বাংলার বাণী’তে প্রকাশিত হয় – রাষ্ট্রসংঘ, ২৯ সেপ্টেম্বর – গতকাল সকালে রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ অধিবেশনে সুইডেন, ফ্রান্স ও সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান চাহেন।৪২ ‘বাংলার বাণী’ পত্রিকার ৫ অক্টোবরে প্রকাশিত হয় – ‘গত ৪ অক্টোবর তারিখের সাধারণ পরিষদে বক্তৃতা দানকালে বেলজিয়ামের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মিঃ পিয়ের হারমেল বলেন, বাংলাদেশ সমস্যার ব্যাপারে জাতিসংঘ যদি নিচেষ্ট থাকে তবে জাতিসংঘ তাহার কৃতিত্বের স্বীকৃতি হইতে বঞ্চিত হইবে। তিনি এই সমস্যা সমাধানের জন্য আরো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।৪৩
মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি সেনাবাহিনী যে অত্যাচার চালাতে থাকে, তাতে বাংলাদেশ থেকে এক কোটি লোক দেশের মাটি ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয়গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। ‘সাপ্তাহিক বাংলা’য় খবর প্রকাশিত হয় এভাবে – ভারতের সর্বশেষ সরকারী হিসাবে জানা গেছে যে বাংলাদেশে থেকে এ পর্যন্ত ৯০ লক্ষ ৯১ হাজার শরনার্থী সীমান্ত পার হয়ে ভারতে গিয়েছে …. ৯৩৪ টি শিবিরের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে এই শরনার্থী শিবিরের সংখ্যা ছিল ৬১৫টি। দ্বিতীয় স্থান – ত্রিপুরা – ২৩৭টি, তৃতীয় আসামা – ২৭টি। বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি স্বাধীনতার আকাঙ্খাকে উদীপ্ত করে। মানুষের মধ্যে তৈরী হয় উদ্দীপনা ও দেশপ্রেম। ‘সাপ্তাহিক বাংলা’য় লেখা হয় – ‘ব্রহ্মপুত্র নদের উভয় তীরে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতার বর্তমানে অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে গেরিলা যোদ্ধাদের হাতে মার খেয়ে খেয়ে পাকসেনারা রংপুর জেলার রাহুমারী ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে’।৪৫
বাংলাদেশের যেখানেই পাকিস্তানি বাহগিনীর ক্যাম্প ছিল সেখানেই ধর্ষণের শিকার হয়েছে নারী। ‘অভিযান’ পত্রিকায় সেই নারকীয় বর্বরতার খবরের কিছু অংশ এই প্রসঙ্গে তুলে ধরা যায় – ‘স্থানীয় মাদ্রসা শিক্ষক আবদুল লতিফ বহু ছেলেমেয়েকে পবিত্র কোরাণ শিক্ষা দিতেন। তাঁর স্ত্রীকে পাকিস্তানী সেনাধ্যক্ষের লালসা নিবৃত্তির জন্য না দিলে তাকে প্রাণ দিতে হয়। ক্যাপ্টেন আতাউল্লার কামরায় শোকার্তা রমণীকে টেনে আনা হয়। তার চোখের সামনে তার একটি ছোট সন্তানকে পশুরা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারে। বাকী দুটি কোনমতে পালিয়া যায়। তারপর থেকে পরবর্তী পাঁচ মাস তার দেহ নিয়ে বর্বরতম উপায়ে ছিনিমিনি খেলছে নরপশুরা।৪৬
বাংলাদেশের মুক্তির স্বপক্ষে সুইডেনেও বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়। ‘দেশ বাংলা’ পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয় – ‘সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমের পাক দূতাবাসের সামনে তিন শতাধিক বিক্ষোভকারী গত ১২ই নভেম্বর রাত্রে বাংলাদেশের সমর্থনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।৪৭ বন্দী শিবিরগুলিতে মধ্যযুগীয় নির্যাতন চালাত পাক বাহিনী। কিশোরী, গর্ভবতী, বৃদ্ধ কাউকেই তারা ক্ষমা করেনি। ‘জয় বাংলা’ পত্রিকার খবরে তারই ইঙ্গিত মেলে – ‘বন্দীদের হাত পা বেঁধে ঢাঙ্গিয়ে পিটানো, আঙ্গুলে সূচ ফোটানো, নখ উপড়ে ফেলা, পায়ে ঠুঁকে ঠুঁকে পেরেক গেঁথে দেওয়া, ব্লেড দিয়ে কেটে চামড়া টেনে উল্টে দেওয়া, যৌনাঙ্গে বিদ্যুৎ প্রবাহ দিয়ে ও গুহাদ্বারে শলাকা বিদ্ধ করে যন্ত্রণা দেওয়া, উলঙ্গ করে বরফে বসিয়ে রাখা, গরম গামলায় মাথা ডুবিয়ে পানিতে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা, মাংস কেটে ক্ষতস্থানে জ্বলন্ত দেশলাই কাঠি বা লাইটার চেপে ধরা এবং দিনের পর দিন বন্দীদের ঘুমাতে না দেওয়া।৪৮ ঢাকার নিকটই ডেমরা অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর লোকেরা লুকিয়ে আছে সশুনে গুলি করে ১২ বছরের ঊর্দ্ধে সব পুরুষ মানুষকে হত্যা করে পাক ফৌজ। কিশোরী, যুবতী ও প্রৌঢ়াদের উপর পাশবিক বলাৎকার চালায়। অথচ ঐ এলাকায় কোন মুক্তিযোদ্ধাই ছিল না।৪৯ মুক্তিযুদ্ধের প্রথম থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্বাধীনতার প্রশ্নে বিশ্বের সকল রাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বীকৃতি দিতে পক্ষে বা বিপক্ষে নানা অবথান নিয়েছিল। এই প্রসঙ্গে ‘জয় বাংলা’ পত্রিকার একটি সংখ্যায় ছাপা হয় – ‘আজ (সোমবার) স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সকার এশিয়ার সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। জয় বাংলা। জয়ত্ব শেখ মুজিব।৫০ ‘জন্মভূমি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় – ‘মুজিবনগর ৬ ডিসেম্বর। আজ সকালবেলা স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতি দেবার পর শীঘ্রই রাশিয়া, পূর্ব জার্মানী, পোল্যান্ড স্বীকৃতি দেবে।৫১ ‘সাপ্তাহিক বাংলাদেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় – ‘সানডে মিরর’ এর সম্পাদকীয়তে বলেছে, বাংলাদেশ, সমস্যা সমাধানে বিশ্বের ধনী দেশগুলি নিষ্ক্রিয়। তারা সমস্যা সমাধান করতে অবহেলা করছে।৫২ ‘জয় বাংলা’ পত্রিকা পাকিস্তানের বাহিনীর বর্বরতার চিত্র তুলে ধরে এভাবে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ধানে দু’টি গ্রামে পাকিস্তানী দস্যু বাহিনীর হানা দেওয়ার পর সমস্ত এলাকাকে তারা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে অসংখ্য বাঙালীকে পৈশাচিক আনন্দে হত্যা করে। ….. বাঁশ ঝাড় এবং সাদা শাপলা ফুলে আচ্ছাদিত একটি পুকুরে খান সৈন্যরা তিন শতাধিক মৃতদেহ ফেলে দেয়।৫৩ ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’ পত্রিকা লেখে ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব কামারুজ্জমান গত ১ ডিসেম্বর কালিগঞ্জ থানায় এক বিরাট জনসভায় ভাষণ দেন। তিনি তার ভাষণে বলেন যে, বাংলাদেশে হবে শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা, তিনি চোরাচালানী ও মুনাফাখোরদের হুঁশিয়ার করে বলেন তারা যদি এই পথ থেকে সরে না দাঁড়ায় তবে তার জন্য উপযুক্ত শাস্তি পেতে হবে।
মার্চ থেকে ডিসেম্বর প্রায়ত নয় মাস ব্যাপী সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নির্বিচারে হত্যা করেছে নারী, পুরুষ, শিশু, কিশোর, বৃদ্ধ নির্বিশেষে লক্ষ লক্ষ বাঙালিকে। যারা প্রতিবাদে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীওনতা ঘোষণা করে হাতে তুলে নেয়, সংগঠিত করে মুক্তিবাহিনী, ১৬ ডিসেম্বর অবশেষে আসে সেই বহু প্রতিক্ষীত দিন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রিয় মানুষ। জয় বাংলা পত্রিকার প্রকাশিত হয় – ‘আজ (বৃহস্পতিবার) বিকেলে ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। অগ্রসরমান মুক্তিবাহনী ও ভারতীয় জোয়ানদের সম্মিলিত অভিযানে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা নগরী মুক্ত হয়েছে এবং সকল সরকারী বেসরকারী ভবনে স্বাধীন বাঙ্গালাদেশের পতাকা উদ্দীন হয়েছে। মুজিবনগর থেকে শীঘ্রই স্বাধীন বাংলার প্রশাসনিক সদর দপ্তর স্থানান্তরিত হচ্ছে বলে জানা গেছে’।৫৪ পাক সরকারের সমস্ত আদেশ অমান্য করে মুজিবনগর সরকার মুক্তাঞ্চলে অগ্রাধিকারতুল্য প্রশাসনিক বিষয়গুলো নিয়ে সরকার যে সব কর্মপন্থা করে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল (১) আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, (২) পাক সৈন্য ও রাজাকারদের বাহিনী যে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র ফেলে গেছে সেগুলো উদ্ধার করা, (৩) ছিন্নমূল জনসাদফহারণকে পুনর্বাসন করানো, (৪) পূর্ণ সরকারী প্রশাসন ও গঠনমূলক তৎপরতা চালানো।৫৫
১৬ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমপর্ণ বাধ্য হয়। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জণ করে স্বাধীনতা প্রিয় বাঙালি যা বিশ্বের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে এক অনন্য নজির। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন – ‘আমরা আশা করি এবং প্রার্থনা করি, নতুন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের মধ্যে তার যথাযোগ্য অভিনন্দন গ্রহণ করবেন এবং শান্তি প্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। আমরা বাংলাদেশের জনগণকে সুভেচ্ছা জানাই, সোনার বাংলায় তাদের জন্য যেন সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়ে ওঠে। এ জয় তাদের একার নয়, যে সব জাতি মানবতার মূল্য দেয় তাদের সকলের জন্য এ জয় অশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।৫৬
২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবর রহমানকে নিঃশর্ত মুক্তির দাবী জানানো হয়। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলা হয় শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। ৮ জানুয়ারী, ১৯৭২ আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে পাকিস্তান বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়। ১২ জানুয়ারী, ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মন্ত্রীসভা পুনর্গঠিত হয়, ঐ দিনই মুঝিবঙ্গর সরকার বা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কর্মকান্ডের পরিসমাপ্তি ঘটে।
সর্বশেষে বাংলাদেশের বিশিষ্ট ছড়াকার লুৎফার রহমান রিটনের কথায় আপামর বাংলাদেশের মানুষ তথা বাঙালির কন্ঠ কন্ঠ মিলিয়ে বলা “সব পেয়েছি সব পেয়েছি শেখ মুজিবের তরে/মুজিব নামের প্রেমের প্রদীপ জ্বলছে ঘরে ঘরে সোনার দেশে সোনামানিক একটি মুজিব ছিল এই দেশ এই স্বাধীনতা সেই-তো-এনে দিল।
সূত্র নির্দেশঃ
১. আবুল কাশেম, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও আওয়ামী লীগঃ ঐতিহাসিক দলিল, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশ, ঢাকা, ২০০০, পৃঃ ২১৯-৩০।
২. মোনায়েম সরকার, বাঙালি শ্রেষ্ঠ বঙ্গবন্ধু; কথা প্রকাশ, বাংলাবাজার, ঢাকা, ২০১৪, পৃঃ ৩৪।
৩. দৈনিক পাকিস্তান, ১২ ডিসেম্বর, ১৯৭০।
৪. তদেব, ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭০।
৫. মোনায়েম সরকার, পূর্বোক্ত, পৃঃ ৩৪।
৬. The Morning News, March 1, 1971.
৭. Pakistan Observer March, 2, 1971.
৮. ইত্তেফাক, ৩ মার্চ, ১৯৭১।
৯. তদেব, ৪ মার্চ, ১৯৭১।
১০. Rao Farman Ali, How Pakistan Govy. Divine, Jung Publishers, Lahore, 1992, P. 55-56.
১১. সংবাদ, ৬ মার্চ, ১৯৭১।
১২. তদেব, ৭ মার্চ, ১৯৭১।
১৩. The Dawn, March 8, 1971.
১৪. সংবাদ, ৮ মার্চ, ১৯৭১।
১৫. ইত্তেকাফ, ৯ মার্চ, ১৯৭১।
১৬. তদেব।
১৭. দৈনিক পাকিস্তান, ১০ মার্চ, ১৯৭১।
১৮. সংবাদ, ১২ মার্চ, ১৯৭১।
১৯. Pakistan Obesrver, March 16, 1971.
২০. দৈনিক পাকিস্তান, ১৭ মার্চ, ১৯৭১।
২১. সংবাদ, ২৩ মার্চ, ১৯৭১।
২২. সংবাদ, ২৫ মার্চ, ১৯৭১।
২৩. দৈনিক বাংলা, ২ মার্চ, ১৯৭১।
২৪. তদেব, ২৬ মার্চ, ১৯৭১।
২৫. মোনায়েম সরকার, পূর্বোক্ত, পৃঃ ৩৬।
২৬. তদেব, পৃঃ ৩৬।
২৭. তদেব, পৃঃ ৩৬ ও ৩৭।
২৮. The Statesman, March 27, 1971, পশ্চিমবঙ্গ।
২৯. মনি হায়দার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কথা প্রকাশ, বাংলাবাজার, ঢাকা, ২০১২, পৃঃ ৪৫।
৩০. বাংলাদেশ (৩) ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১।
৩১. দৈনিক যুগান্তর, ৮ এপ্রিল, ১৯৭১।
৩২. মওসুদ আহমদ, বাংলাদেশ স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা, ইউ.পি.এল. ঢাকা, পৃঃ ২২০।
৩৩. জয়বাংলা (১), ১১ মে, ১৯৭১, মুজিবনগর।
৩৪. জয়বাংলা (৩),১৭ জুলাই, ১৭৯১, মুক্তিফৌজ, বাংলাদেশ।
৩৫. তদেব।
৩৬. জাগ্রত বাংলা, ১ আগষ্ট, ১৯৭১, ময়মনসিংহ।
৩৭. বিপ্লবী বাংলাদেশ, ৪ আগষ্ট, ১৯৭১, মুজিবনগর।
৩৮. জয়বাংলা (১), ২৭ আগষ্ট, ১৯৭১, মুজিবনগর।
৩৯. বিপ্লবী বাংলাদেশ, ২৯ আগষ্ট, ১৯৭১, মুজিবনগর।
৪০. সাপ্তাহিক বাংলা, ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১, মুজিবনগর, সিলেট।
৪১. তদেব।
৪২. বাংলার বাণী, ৫ অক্টোবর, ১৯৭১।
৪৩. তদেব।
৪৪. সাপ্তাহিক বাংলা, ১০ অক্টোবর, ১৯৭১।
৪৫. তদেব।
৪৬. অভিযান, ২৫ নভেম্বর, ১৯৭১, ঢাকা।
৪৭. দেশ বাংলা, ১৮ নভেম্বর, ১৯৭১, ঢাকা।
৪৮. জয়বাংলা (১), ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১, মুজিবনগর।
৪৯. তদেব।
৫০. তদেব, ৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১।
৫২. বাংলাদেশ (৪), ১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১।
৫৩. জয়বাংলা (১), ১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১, মুজিবনগর।
৫৪. তদেব, ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১।
৫৫. অভিযান, ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১, ঢাকা।
৫৬. অভিযান, ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১, ঢাকা।
লেখক, বিভাগীয় প্রধান, ইতিহাস বিভাগ,ও ভাইস প্রিন্সিপাল, সিটি কলেজ, আমহার্স্ট স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০৯