পৌষ মাস। বিকেল হয়হয়। ঝুল বারান্দায় চেয়ারে বসে আছি। রৌদ্রের তেজ এমনিতেই কম। তার উপর উত্তরে হাওয়া বইছে। হিমহিম শীতে যেন একটু শিরশিরে লাগছে। কপালের ভাঁজে যদিও বা সূর্য রশ্মি তির্যক ভাবে পড়ছে! এতে মন্দ লাগছে না। ওম ওম মুহূর্ত! আবেশ বিহ্বল! অনুরণিত দেহমন। কেননা, প্রতিক্ষণে কিছু না কিছু স্মৃতি লুটোপুটি খায় মনের অলিন্দে। জাবর কাটি। স্মৃতির ওপর জমানো পলেস্তারা সরাই। নতুন করে স্মৃতিকে হাতছানি দিই। জীবন্ত করে তুলি কাঙ্ক্ষিত স্মৃতিচারণ। বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে পৃষ্ঠাগুলো যেমন নরম ও মলিন হয়ে যায়। তেমনি স্মৃতিগুলোও যেন ইদানীং ঝাঁপসা, ফিকে হয়ে আসছে।
মাস্টার্স পাশ করার পরপরই বিয়ে করলাম সুদর্শন প্রেমিক পুরুষটিকে। দুজনেই উচ্চে পদে জব করতাম। বিয়ের দুবছর বছর যেতে না যেতেই আমার কোলে এলো পুত্রসন্তান ধ্রুব। ও আমাদের দুজনের সংসারে ধ্রুব তারার মতোই দ্যুতি ছড়াচ্ছে। এর দুবছরের মাথায় এল ছন্দা, আমার মেয়ে। অফিস ও সংসার সামলিয়ে আমি যেন হাঁফিয়ে উঠছিলাম। কাজের মেয়ে ছিল বলে রক্ষে। আমার বাচ্চা দুটো মায়ের তত্ত্বাবধানে বাড়তে লাগল। বুঝতেই পারিনি কখন যেন ওরা বড় হয়ে ওঠছে। স্কুলে ভর্তি করা হলো দুজনকেই। মা অসুস্থতার কারণে এখন আর আগের মতো পারছে না। এমনি সমস্যা-সংকট মুহূর্তে হঠাৎ কাজের মেয়েটিকে তার অভিভাবক নিয়ে যায়। মা আমার কষ্ট দেখে চিন্তিত। তাই গ্রামের বাড়ি গেলেন। গ্রামের এক প্রতিবেশীর বিধবা নিঃসন্তান মহিলাকে নিয়ে এলেন। বিধবা জাকিয়া এসে সংসারের সব দায়িত্ব বুঝে নেয়। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। জাকিয়াও নিরাপদ আশ্রয় পেয়ে খুশি।
কেটে গেল দুবছর। হঠাৎ আমার মা মারা গেলেন। আমার জীবনে নেমে এল ঘোর অমানিশা। মায়ের শোকের রেশ কাটেনি তখনো। থেমে থেমে আমাকে শোকাভিভূত করে তোলে। এমনি এক আষাঢ়ের বর্ষণমুখর দিনে আমার স্বামী দেবতা জাকিয়াকে বিয়ে করে ঘরে তোলে। আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। আমি স্থির, নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে থাকি। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি। কারণ, আমি জানতাম, ভালোবাসা মানুষকে আরও বেশি মানুষ করে। শ্বাপদ করে না। সাত বছর চুটিয়ে প্রেম করে বিয়ে করেছিলাম প্রাণবান মুহিদকে। আমাদের মধ্যে ভালোবাসার এতটুকু কৃত্রিমতা ছিল না। ও ছিল আমার স্বপ্নের পুরুষ। ওর ভালোবাসার হৃদিসরোবরে ডুবসাঁতারে অবগাহন করতাম প্রতিনিয়ত। এক অনির্বচনীয় সুখ-সম্ভোগে আবিষ্ট হতাম। প্রতিটি রাতই মনে হতো বাসর রাত। মনে হতো এই যেন আমার পুরুষস্পর্শহীন শরীরে প্রথম স্পর্শিত মুহূর্ত! আসলে, ওর চাহনি, ওর স্পর্শ আমি চোখ বুঝে অনুভব করতাম। এই যেন এক ঘোরলাগা স্থূল কোন মোহমায়া! আমাকে ওর প্রতি সারাক্ষণ আকণ্ঠমগ্ন রাখত। অফিসে গেলেও ওর স্পর্শিত অনুরণন আমার দেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুরণিত হতো। ওর রোমাঞ্চকর এক্সপ্রেশনে শিহরিত হতাম। আমার প্রতি ওর অনুভূতির প্রকাশটা ছিল আরও রোমান্টিক। তাই তো তার অতল ভালোবাসায় ডুবে থাকতাম দিনরাত। কাজেও পেতাম প্রণোদনা। তাই তো নতুন উদ্যমে উজ্জীবিত হতাম। এক অলোকসামান্য ভালোবাসার সঞ্জিবনী শক্তিতে আমরা পরস্পর ছিলাম রাজযোটক। তবুও বেঁধে রাখতে পারলাম না ওকে। ব্যর্থ আমি। অঝোরে কাঁদলাম দুমাস পর্যন্ত। ভালোবাসায় আমার সবচেয়ে বড় অর্জন স্বামী আর সংসার। দুটোই বিসর্জন দিলাম। সংসারের সব দায়িত্ব ছেড়ে দিলাম জাকিয়ার ওপর।
সেই থেকে এতটা বছর সংসার করেছি। একদিনের জন্যও স্বামীর শয্যাসঙ্গী হইনি। কারণ, ওর নিরানন্দিত শরীরে আমি আর পিষ্ট হতে চাই নি। ওর প্রতি আমার ঘৃণায়ও অরুচি ছিল। তবে জাকিয়ার প্রতি এতটুকু খারাপ আচরণ আমি করিনি। ওর একটি মেয়ে হলো। আমি ওকে আমার মেয়ের মতোই আদর করতাম। দিন যায়। সময়েই সবকিছু সয়ে নিতে সহায়তা করে। উচ্চ শিক্ষার্থে আমার ছেলেটিকে আমেরিকা পাঠালাম। মেয়েটিকে এম এ পাশ করালাম। কলেজ শিক্ষকের কাছে বিয়ে দিলাম। মেয়েটিও একটা ভালো জব করছে। ব্যাস! আমার দায়িত্ব শেষ। ওদের জন্যই আমার এই আত্মত্যাগ। সর্বস্ব বিসর্জন। অবসরে গেলাম। মোটা অংকের টাকা পেলাম। সংসারে দেওয়ার পরও বেতনের টাকা জমেছে বেশ।
অখণ্ড অবসরে জীবনটা ফাগুনের ঝরা পাতার মতো মনে হলো নিজেকে। বাসার পরিস্থিতি অস্বস্তিকর। চক্ষুষ্মান উপলব্ধির বিরূপ বিরূপতার গভীরতা আমাকে পীড়ন করত। এই একাকীত্বের ঝাঁঝ যেন এক কঠিন বাস্তবতা। তাই ছেলেকে ফোনে জানালাম, একসাথে আমি আর থাকব না। ইতোমধ্যে ছেলে সেটেল্ড হলো আমেরিকায়। বিয়েও করেছে। ছেলে আমার জন্য একটা ফ্লাট কিনে দিল। আমিও কিছু টাকা দিলাম। একই ভবনের মেয়ের ফ্লাটের দোতালায় আমি। মেয়ে সাততলায়। বউ পাগল স্বামী বলে অফিসের কলিগরা মশকরা করত। দিনে কতবার যে ফোন করত। সুখী-দম্পতি বলে অনেকেই ঈর্ষান্বিত ছিল। দাম্পত্যকলহ কি তা বুঝতাম না। তবে কেন যে আমার জীবনের অক্সিজেন সাপ্লাই এতটা কমে যাবে জানতাম না। কী ভয়ংকর শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা আমার! উপলব্ধির শিরায় শিরায় তা যেন টের পাচ্ছি। আসলে অনেক মেয়েরা কেবল অন্যের পছন্দমতো বেঁচে থাকতে বাধ্য হয়। মেয়েদের নিজের কোন পছন্দ-টছন্দ থাকতে নেই। তেমনি আমিও একজন লক্ষীসোনা বউ। দ্বিতীয় স্ত্রী পরিগ্রহ করায় নির্দ্ধিধায় মেনে নিয়েছি। দুই স্ত্রীকেই ও পরিচয় করিয়ে দিত গলা উঁচা করে। এতে ও এতটুকু লজ্জিত হতো না। একই বাসায়, এতটা উত্তাপের দাহ! উহ! আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব ছিল না। ভাবছি, এখন থেকে নিজের অস্তিত্বে এবং নিজের ব্যক্তিত্বে ভর করে বাঁচব। সিলিন্ডারের অক্সিজেন আর নয়, প্রকৃতির সান্নিধ্যে মুক্ত বিহঙ্গের মতো বিশুদ্ধ অক্সিজেন নিয়ে বাঁচতে চাই।
তাই ফ্লাটে আসার সিদ্ধান্তটা আমিই জাকিয়াকে জানালাম। ওর মেয়ে পশরা শুনে কান্না জুড়ে দিল। কলেজ পড়ুয়া অষ্টাদশী পশরা আমাকে বড়মা বলে ডাকত। আমি ওকে মাতৃস্নেহের চাদরে জড়িয়ে রাখতাম। ও বুঝতে পারছে, তার মা ও বাবার ঘরবাঁধা আমার জীবনটাকে হালপালবিহীন নৌকার মতো করে দিয়েছে। তথাপি এতটা বছর প্রতি মুহূর্তে আমি খচখচ করে বিদ্ধ হতাম শতকাঁটার আঘাতে। এখন এই আঘাতের জায়গায় ক্ষতগুলো অনেক বড় হয়ে গেছে। এতে রক্তক্ষরণ হয়। শত মলমের প্রলেপেও কাজ হয় না। বরঘর তো আগেই ছেড়ে দিয়েছি বীনা বাক্যব্যয়ে। এখন একটু চোখের আড়ালের বিস্বাদ নিতে চাই। ওরা দুজনের নিজের মতো করে সংসার করুক। এতটা দিন অফিসে ব্যয় করতাম দিনের বেশিটা সময়। বাসায় আসতাম ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে। খাওয়ার পর বারান্দায় একটু বসতাম। ঘুম আসা মাত্র শুয়ে পড়তাম। নিদ্রাদেবী বেশ দয়াপরবশ হয়ে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতেন। অফিসের কাজ আর রাতের নিশ্ছিদ্র ঘুমই আমাকে কর্মক্ষম ও চিন্তামুক্ত রেখেছে।
বাসায় আমার বেশিক্ষণ থাকা হতো না। ওকে কথা বলার সুযোগও দিই নি। অফিস টাইমের আগেই আমি চলে আসতাম। আবার রাতে নিজের কক্ষ থেকে কখনো বের হইনি। আমার খাবারও জাকিয়া আমার রুমেই পাঠায়ে দিত।
জীবনে এক মর্মন্তুদ চিরায়ত বাস্তবতা যে, মেয়েরা অনেকেই স্বপ্ন-স্বাধ বা ইচ্ছার সঙ্গে বিরাট এক দূরত্ব মেনে নিয়েই বেঁচে থাকে। শত কষ্টের দ্যোতনা নিয়ে এই দূরত্বে বেঁচে থাকাটা হয়তো একটা অবলম্বনও বটে। অভিমান কিংবা ক্ষোভ কোন স্তরেই একে ফেলা যায় না। স্বামী-সন্তানদের নিয়ে হৃদয়বাগানে কতনা ফুলের চাষ করেছি। হঠাৎ দেখি এই তো ফুল নয়, সবই মোর ভুল। সে সব মনে পড়লেই বিস্মরণ স্মৃতি হৃদয়ে হুল ফোটায়। সে অর্থে এই তো আছি বেশ! হই না বড় একা। হই না বঞ্চিত। তবুও ভালো আছি। সংসার নামক খাঁচা যে জ্বলন্ত হুতাশন। সে উত্তাপ আমাকে পুড়ে খাকখাক করে দিত। আমি অঙ্গার হতাম। ছাইভষ্ম হতাম।
পাঁচ বছরের একাকীত্ব জীবনেও বেঁচে আছি। প্রাক সন্ধ্যার হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা। ওঠিওঠি করছি। মোমেনার হাঁড়িকুঁড়ি ধোয়ার টুংটাং আওয়াজ শোনা যায়। হঠাৎ ডোর বেল বেজে ওঠল। এমন সময় আবার কে এল? একনাগাড়ে তিন তিনবার বেল বাজল। তবে কি ও? নাহ! ও হতে যাবে কেন? ও কী আর এখন আমার আছে? নাত-নাতনী, মেয়ে-জামাই, পশরা, ওর স্বামীর বেল টিপাও আমি বুঝি। তাহলে? দোনোমোনো করে দরজা খুলি। দেখি, কোথাও কেউ নেই! ভাবছি, ও আসতে পারে এটা কেন মনে হলো আমার! আমি কি তাহলে ওকে এখনো ভালোবাসি? নাহ! তা হবে কেন? এলোপাতাড়ি ভাবনায় বিভোর। আমি স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে রইলাম দরজাটা ধরে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক।